আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ইস্যু
আজকের লেখাটি
পড়ে অনেকেই হয়তোবা ভাবতে পারেন আমার মধ্যে 'আমেরিকা
প্রীতি' কাজ করছে বা আমি একজন Pro American। আসলে আমি Pro American বা Pro
Taliban কোনটাই না। আফগানিস্তান ও
তালেবান নিয়ে মানুষজনের এতো বেশি লেখালিখি দেখে ভেবেছিলাম আফগানিস্তান নিয়ে আর
কখনো ফেসবুকে লিখবো না। কারন এই ইস্যুটা এখন ওভাররেইটেড।
আসলে
আফগানিস্তান নিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়াগুলির এতো বেশি তৎপরতা দেখে হতাশ হতাম না, যদি মিডিয়াগুলো বাস্তবতা তুলে ধরতে পারতো। লক্ষ করে দেখলাম প্রায়
সবগুলো মিডিয়ার হেডিং গুলা এরকম-
- "আফগানিস্তান থেকে শূন্য হাতে ফিরছে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র"
- "শান্তি না ফিরিয়ে আফগান ছাড়ছে ন্যাটো সৈন্যরা"
- "তালেবানদের ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালালো মার্কিন সেনারা"
- " সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো
ভুল করলেন জো বাইডেন "
উপরোক্ত
মুখরোচক এসব হেডলাইন দেখে আমার মনে কয়েকটা প্রশ্ন জাগলো। প্রশ্নগুলো হলো;
এক-
আফগানিস্তান ইস্যাুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন আর কী কাজ করা বাকি আছে যেগুলো
করতে পারলে আমরা বলতে পারতাম যুক্তরাষ্ট্র খালি হাতে ফেরেনি?
দুই- আসলেই কি
যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে শান্তি ও গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে এসেছিলো?
তিন-
যুক্তরাষ্ট্র কি আসলেই আফগানিস্তান ইস্যুতে সফল হয় নি?
চার-
ভ্যাটেরান ও চতুর জো বাইডেনের আফগানিস্তান থেকে সকল মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের
সীদ্ধান্তটা কি ভুল ছিলো?
পাচ-
আফগানিস্তানকে ধ্বংস করার মতো কি আর কিছু বাকি আছে?
আজ থেকে ঠিক
বিশ বছর আগে যখন ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তানের মাটিতে পা রাখে তখন যুক্তরাষ্ট্রের
প্রসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ বলেছিলো তাদের উদ্দেশ্য হয়েছে তিনটা। প্রথমত, আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। তৃতীয়ত, জঙ্গিবাদ দমন করা। আজকে ২০২১ সালে এসেও আফগানিস্তানে শান্তিও নেই, গনতন্ত্রও নেই। এখন এই দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি বলতে পারেন
যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ বা খালি হাতে ফিরে যাচ্ছে। যেহেতু তাদের উদ্দেশ্যই ছিলো
শান্তি ও গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা কিন্তু কোনটাই তারা পারেনি।
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম প্রেসিডেন্ট জেমস মনরোর শাশনামল থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত
যারাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন তাদের সকলের পররাষ্ট্র নীতিগুলো একটু
এ্যানালাইসিস করলে আপনি দুইটা বিষয় বা ধারা খুঁজে পাবেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র
নীতির সেই দুইটা গোল বা উদ্দেশ্য হলো;
এক- Normative Goal:
নরমেটিভ এর মানে হলো আদর্শগত।
এমন কিছু করা যেটা আসলেই করা উচিত বা নীতিগত ভাবে সঠিক। ধরুন একটা দেশ খুবই সংকটে
আছে, সেদেশের জনগণ খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছে, রাজনৈতিক সহিংসতা রয়েছে, মানবাধিকার
অনুপস্থিত এবং গৃহযুদ্ধে মানুষ মারা যাচ্ছে। তাই একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে
যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সংকটে পড়া সে দেশটির পাশে দাড়িয়ে সংকটের সমাধান করা, গৃহযুদ্ধ বন্ধ করা,
শান্তি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করা।
এবং যুক্তরাষ্ট্রও এটা বিশ্বাস করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের
নেতৃত্ব আবশ্যক।
দুই- Realistic Goal:
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির
দ্বিতীয় গোল হলো যে করেই হোক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের
মেটেরিয়ালিস্টিক লাভ। যে কাজটা করলে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র
ঠিক সেই কাজটাই করবে। এতে অন্য কারো ক্ষতি হলো নাকি লাভ হলো এসব যুক্তরাষ্ট্র দেখে
না। ধরুন একটা পররাষ্ট্রনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক লাভ কিন্তু সেই নীতিটা অন্য
আরেকটা রাষ্ট্রের জন্য বিশাল ক্ষতি বয়ে আনবে তখন যুক্তরাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের
ক্ষতির কথা বিবেচনা করে না। অর্থাৎ নিজের লাভ হলেই হলো। সহজ কথায় যুক্তরাষ্ট্র Zero- Sum Game এ বিশ্বাস করে। এই জিরো সাম গেইম এর মানে হলো
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোন একটা ইস্যুর উপর জড়িত দুইটা দেশ একসাথে লাভবান হতে পারে
না। একটা রাষ্ট্রের লাভবান হওয়া মানেই অন্য আরেকটা রাষ্ট্র নিশ্চিত ক্ষতিগ্রস্ত
হওয়া। যুক্তরাষ্ট্র জানতো ইরাক বা লিবিয়ায় যুদ্ধ করলে যুক্তরাষ্ট্রের লাভ হবে
কিন্তু ইরাক ও লিবিয়া দুটি দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র নিজের লাভের কথা
বিবেচনা করে যুদ্ধকেই বেছে নিয়েছিলো।
যুক্তরাষ্ট্রের
পররাষ্ট্রনীতির এই দুইটা ধারার প্রথমটা (Normative Goal) হলো এক কথায়
ভাঁওতাবাজি। যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই বলে আমরা বিশ্ব গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই, বিশ্বে শান্তি
আনতে চাই। এটা স্রেফ একটা আই ওয়াশ। আর দ্বিতীয় যে ধারাটা (Realistic Goal) এটাই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। আফগানিস্তানে গনতন্ত্র
প্রতিষ্ঠা করা কিংবা শান্তি প্রতিষ্ঠা করা এটাও ছিলো একটা আই ওয়াশ। কারন
যুক্তরাষ্ট্রের এখন ভাষ্য হলো আফগানিস্তানে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা এটা
যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব না। জো বাইডেন বলছেন আফগানিস্তানে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার
দায়িত্ব আফগান সরকার ও আফগান জনগনের। আফগানিস্তানকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের
পররাষ্ট্রনীতির দ্বিতীয় যে রিয়ালিস্টিক উদ্দেশ্য সেটা ঠিকই আদায় করে নিয়েছে। এখন
প্রশ্ন হতে পারে কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হলো?
এক-
আফগানিস্তান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক লক্ষ ছিলো ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিশোধ
নেওয়া। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ এই দীর্ঘ বিশ বছর যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে যুদ্ধ করে জয়ী হতে
পারেনি। দক্ষিণ ভিয়েতনামিজদের ততকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন অত্যাধুনিক মিসাইল ও
রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করেছিলো যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়তে। ফলস্বরূপ
যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার সেনা নিহত হয় এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে
যুক্তরাষ্ট্রকে বাড়ি ফিরতে হয়। ১৯৭৯ সাল থেকল ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত চলা আফগান- সোভিয়েত
যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ঠিক সেইম কাজটা করে। যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের আধুনিক
অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় তালেবানরা সোভিয়েতদের
বিরুদ্ধে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে। তালেবানদের হাতে হাজার হাজার সোভিয়েত সেনা নিহত
হয়। অবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজয় বরণ করে আফগানিস্তান ত্যাগ করে। সময়টা যেহেতু
কোল্ড ওয়ার পিরিয়ড তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তালেবানদের জয়কে মূলত
যুক্তরাষ্ট্রের জয় হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এই দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র সফল।
দুই-
আফগানিস্তান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় আরেকটি উদ্দেশ্য ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের
সিকিউরিটি নিশ্চিত করা। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে তালেবান ও আলকায়দা মিলে খুবই
শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। যেটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড়ো একটা থ্রেট ছিলো।
আফগানিস্তানে গত বিশ বছরের ন্যাটো বাহিনীর অবস্থান তালেবানদের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে
দিয়েছে। তালেবানদের নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্ধ বাধাতে সক্ষম হয়েছে
যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯৫ সালের দিকে সকল তালেবান যেভাবে এক ছিলো এখন কিন্তু সেরকম নেই।
তালেবানরা এখন নিজেরা নিজেদের মধ্যে খনিজ সম্পদ ও ক্ষমতার প্রশ্নে বিবাদে লিপ্ত।
এখন যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটির জন্য তালেবানরা আর থ্রেট না। যুক্তরাষ্ট্র তার
সিকিউরিটির জন্য এখন তিনটা রাষ্ট্রকে হুমকি মনে করে - রাশিয়া, ইরান, চীন। তাই আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন বজায় রেখে বিলিয়ন
বিলিয়ন ডলার অপচয় করতে চায় না জো বাইডেন। ২০২১ সালে এসে আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন
রেখে যুক্তরাষ্ট্রের আসলে কোন লাভ নেই। আফগানিস্তানে যে পরিমাণ টাকা খরচ হতো সেসব
টাকা এখন যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য কাজে ব্যবহার করতে পারবে। আফগানিস্তানে শুধু শুধু
খরচ না করে মহামারীর ফলে ভেঙে যাওয়া অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করাই জো বাইডেনের
প্রাধান্য। Cost Benefit Analyses এর দিখ থেকে জো বাইডেন যা করছেন তাই ঠিকই আছে। আপনিই
বলুন আফগানিস্তানে ২০২১ সালে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা মোতায়েন বজায় রাখার কোন
প্রয়োজনীয়তা আছে?
তিন-
যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে চলে যাচ্ছে কিন্তু এখানে একটা ক্যাচাল সৃষ্টি করে
দিয়ে যাচ্ছে। ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক ও
তালেবান এখন মারামারি করবে যুক্তরাষ্ট্র বসে বসে দেখবে। ঠিক সেজন্যই ন্যাটোর
প্রতিনিধি হিসেবে তুরস্ককে আফগান বিমানবন্দরে দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র
সিরিয়া, লিবিয়া,
ইরাকের মতো মুসলিম বিশ্বের প্রায়
অনেকগুলো দেশই ধ্বংস করেতে সক্ষম হয়েছে। তুরস্ক এখন বিশ্বে উদীয়মান শক্তি। তুরস্ক
ছাড়া মুসলিম বিশ্বের শক্তিশালি আর কোন দেশ নেই যেটা যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য
থ্রেট হতে পারে। হান্টিংটনের ক্লাশ অব সিভিলাইজেশ্যন তত্ত্ব মতে তুরস্ক যদি দিনদিন
এভাবে শক্তিশালী হতে থাকে সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোন ভালো খবর নয়। এটার
গ্যারান্টি কে দিবে - যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের পুনরায় সহযোগীতা করে তালেবানদেরকে
তুরস্কের বিরুদ্ধে লাগাবে না?
এটার নিশ্চয়তা কে দিবে যে
তালেবানদেরকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র দুটি মুসলিম দেশ তুরস্ক ও পাকিস্তানকে
মুখামুখি দাড় করাবে না? নোট: গত কয়েকমাস ধরে তালেবানদেরকে আর জো বাইডেন জঙ্গি
হিসেবে উল্লেখ করে না। কিন্তু কেন?
কারনটা বলতে পারবেন? সকল ন্যাটো সেনা আফগান ত্যাগ করার পর তালেবানরা ক্ষমতায় আসবে এটা
যুক্তরাষ্ট্র ভালো করেই জানে এবং যুক্তরাষ্ট্রও এখন চায় তালেবান ক্ষমতায় আসুক।
তালেবানরা যেন ক্ষমতায় আসে ঠিক সেজন্যই জো বাইডেন আশরাফ গানী ও তালেবানদের মধ্যে
কোন সমঝোতা করে দিয়ে যাননি।
যারা সারাদিন
বলতেছেন যুক্তরাষ্ট্র খালি হাতে এবং কিছু না নিয়ে ফিরে যাচ্ছে, তুরস্ক ঠিকই তালেবানদের সাথে একটা সমঝোতা করে নিবে, তালেবান- পাকিস্তান- তুরস্ক মিলে নতুন শক্তিশালী জোট হবে তাদেরকে
বলি যুক্তরাষ্ট্র খালি হাতে যাচ্ছে না, বরং নতুন একটা
খেলা শুরু করে দিয়ে যাচ্ছে......
মোঃ মিরাজ মিয়া